মুসলিম মডার্ন একাডেমির ইতিহাস ও ঐতিহ্য:
তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে ঢাকা সেনানিবাসে বাঙালি ছেলে মেয়েদের জন্য বাংলা ভাষার কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিলনা। ক্যান্টনমেন্ট মর্ডান স্কুল (বর্তমানে শহীদ বীর উত্তম লেঃ আনোয়ার গার্লস কলেজ), আইয়ুব লাইন স্কুল (বর্তমানে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল), বিএএফ শাহীন স্কুল তেজগাঁও ও আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর অফিসার, জেসিও ও সৈনিকদের ছেলে-মেয়েরা ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লেখাপড়া করার সুযোগ পেত। তৎকালীন এতদাঞ্চলে (কচুক্ষেত, ইব্রাহিমপুর, কাফরুল, ভাষানটেক, মানিকদি) বাংলা ভাষার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। এ বাস্তবতায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের প্রাণকেন্দ্র তথা কচুক্ষেত এলাকার কতিপয় বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী, সমাজ সেবক ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি (যাঁরা চাকরিসূত্রে অত্র এলাকার বাসিন্দা ছিলেন) দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করেন যে, বাঙালি ছেলে মেয়েদের জন্য বাংলা ভাষার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখানে একান্ত জরুরি। তাদের মধ্যে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব:) এবিএম আব্দুর রশিদ ও তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী সম্মিলিতভাবে বাংলা ভাষার একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব:) এবিএম আব্দুর রশিদ চাকরির সুবাদে ১৯৫৮ সালে কচুক্ষেত এলাকায় বেশ কিছু জমি ক্রয় করেন এবং বসতবাড়ি নির্মাণ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর জীবনে এসে বাঙালি ছেলে-মেয়েদের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নিজস্ব টিনশেড ঘর এবং মোটা অংকের অর্থ বিদ্যালয়ের জন্য দান করেন এবং ১৯৬৩ সালের এ ঘরগুলোতেই বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের সূচনা হয়। প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য শুরুতেই একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রথম সভায় উপস্থিত সদস্যবৃন্দের আলোচনায় সর্বসম্মতভাবে বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয় ‘মুসলিম মডার্ন একাডেমি। এ নামেই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি তার সুখ্যাতি অর্জন করে এগিয়ে চলছে। শুরুতে বিদ্যালয়টি প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু হয়। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক হিসেবে ছিলেন সর্বজনাব মোঃ রফিকুল ইসলাম (প্রধান শিক্ষক), আব্দুল লতিফ মাস্টার, আবুল খায়ের মাস্টার, আব্দুল হক, আনিসুল ইসলাম, আবু তাহের, শামসুল হুদা ও মোল্লা মাস্টার। শিক্ষাদানের পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড, নাটক, অভিনয় ইত্যাদিতে ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তাদের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ছাত্র ছাত্রীদের খেলাধুলার জন্য একটি ফাঁকা মাঠের প্রয়োজন ছিল। এলক্ষ্যে প্রতিষ্ঠাতা ১৯৬৪ সাল থেকেই তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারি স্টেট অফিসারের কার্যালয়ে যোগাযোগ করতে থাকেন। পাকিস্তানের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিকে মাঝেমধ্যেই বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসতেন। তারা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনার মান, শিক্ষকমণ্ডলীর পেশাদারিত্ব এবং বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সুব্যবস্থাপনা দেখে মুগ্ধ হতেন। পরিদর্শকবৃন্দ বিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে মোটা অংকের টাকা দান করতেন। এভাবে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠাতা ও সহযোগী সদস্যবৃন্দের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬৯-৭০ সালে বিদ্যালয়ের উত্তর পাশের অর্থাৎ বর্তমান মূল ভবনটির ৩ টি পাকা কক্ষ নির্মাণ করা হয়। তখনও পশ্চিম পাশের কিছু অংশে দোতলা কাঠের ঘর এবং একতলা টিনশেড ছিল। পর্যায়ক্রমে উত্তর পাশের একতলা পাকা ভবনটি সহ পশ্চিম পাশের দোতালা কাঠের ঘর পর্যন্ত এল টাইপের দোতলা পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়।
১৯৬৮ সালে অত্র বিদ্যালয় হতে প্রথম ব্যাচে ৯ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়। ১৯৭৩ সালে ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষ ছাত্র-ছাত্রীদের খেলাধুলার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যালয়ের নামে দুই একর পরিমাণ জায়গা খেলার মাঠ হিসেবে প্রদান করেন। ফলে সবার প্রাণের এ প্রতিষ্ঠান পায় ডানামেলা উন্মুক্ত প্রান্তর। ১৯৭৬ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বোর্ড প্রতিষ্ঠানটি অধিগ্রহণ করে। অধিগ্রহণকালীন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন জনাব মোঃ মোজাম্মেল হোসেন তালুকদার। তিনি সহ সকল শিক্ষকমণ্ডলীকে নতুনভাবে নিয়োগপত্র প্রদানের মাধ্যমে পুনরায় অত্র প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অধিগ্রহণের পর পরই ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অর্থায়নে বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এল টাইপের দোতলা ভবনটি তৃতীয় তলায় রূপান্তর করা হয়। প্রতিনিয়ত ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে ধাকায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড চাহিদা মোতাবেক অবকাঠামো নির্মাণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রধাক। আশির দশকের শুরুতে এসে পশ্চিম পাশের নতুন বিল্ডিং এর একতলা ভবনটি নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৭-৮৮ সালে সেটি দ্বিতীয় তলা এবং নব্বইয়ের দশকে তৃতীয় তলায় রূপান্তর করা হয়। ১৯৯২ সালে ছাত্র-ছাত্রীদের চাহিদার প্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে একটি ক্যান্টিন স্থাপন করেন। ২০০৯ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা ও প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশের এক তলা ভবনটি নির্মাণ করা হয়। ২০১২ সালে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড বিদ্যালয়ের উত্তর পাশের অভিভাবক শেড নির্মাণ করেন। ২০১৭-১৮ সালে বিদ্যালয়ের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান এসজিপি, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি মহাপরিচালক, ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড, ঢাকা সেনানিবাস ঢাকা, মহোদয়ের বদান্যতায় এবং নিজস্ব অর্থায়নে বিদ্যালয়ের আমূল সংস্কার সাধিত হয়। দীর্ঘদিনের পুরনো প্রতিষ্ঠানটি তার খোলস ছেড়ে আধুনিক সাজে সজ্জিত হয়। ২০১৯ সালে বিদ্যালয়ের যাবতীয় নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজে সামরিক ভূমি ও সেনানিবাস অধিদপ্তর, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড ও অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকমণ্ডলী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড কর্তৃক অধিগ্রহণের পর থেকে অদ্যাবধি যারা প্রধান শিক্ষক হিসেবে প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, দক্ষতা, সাহসিকতা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে স্ব-স্ব কর্মকাল অত্যন্ত নির্বিঘ্নে ও সফলতার সাথে অতিবাহিত করে প্রতিষ্ঠানের সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন:
ক্রোঃ নং | নাম | কার্যকাল |
---|---|---|
০১ | জনাব মোঃ তোজাম্মেল হোসেন তালুকদার | ০১-০৭-১৯৭৬ থেকে ২৫-০৪-১৯৮৪ পর্যন্ত। |
০২ | জনাব মোঃ ইউনুছ মিঞা চৌধুরী | ০১-০৫-১৯৮৪ থেকে ২৯-০৮-১৯৮৯ পর্যন। |
০৩ | জনাব মোঃ ফয়েজ উল্লাহ | ২৮-১২-১৯৮৯ থেকে ২৭-১২-১৯৯৫ পর্যন্ত। |
০৪ | জনাব মোঃ জয়নাল আবেদীন | ২০-০৬-১৯৯৬ থেকে ২২-১২-১৯৯৭ পর্যন্ত। |
০৫ | জনাব মোঃ জাহিদুল ইসলাম | ২৩-১২-১৯৯৭ থেকে ১৯-১২-২০০১ পর্যন্ত। |
০৬ | জনাব মোঃ জয়নাল আবেদীন | ২০-১২-২০০১ থেকে ২৭-০১-২০০৪ পর্যন্ত। |
০৭ | জনাব মোঃ আব্দুর রহমান | ২৮-০১-২০০৪ থেকে ৩১-০১-২০০৫ পর্যন্ত। |
০৮ | জনাব মোঃ আব্দুল আউয়াল | ০১-০২-২০০৫ থেকে ১৮-১২-২০০৫ পর্যন্ত। |
০৯ | জনাবা ফিরোজা বেগম | ১৮-১২-২০০৫ থেকে ২৮.১০.২০০৯ পর্যন্ত। |
১০ | জনাব মোঃ নূরুল ইসলাম | ০১-১১-২০০৯ থেকে ২৯-০৩-২০১০ পর্যন্ত। |
১১ | জনাবা ফিরোজা বেগম | ০৭-০৪-২০১০ থেকে ২০-১০-২০১৬ পর্যন্ত। |
১২ | জনাব মোঃ শফিকুল আলম (ভারপ্রাপ্ত) | ০৫-১০-২০১৬ থেকে ৩১-১০-২০১৬ পর্যন্ত। |
১৩ | জনাব মোঃ এবিএম নজরুল ইসলাম | ০১-১১-২০১৬ থেকে ১৪-০৭-১৮ পর্যন্ত। |
১৪ | জনাব রতন চন্দ্র দত্ত | ০২-০৮-১৮ থেকে ০২-০১-১৯ পর্যন্ত। |
১৫ | জনাব নাজমা নাহার (ভারপ্রাপ্ত) | ০৩-০১-১৯ থেকে ১৩-০১-১৯ পর্যন্ত। |
১৬ | মোঃ খন্দকার মুশতাক আহমদ আলমগীর | ১৪-০১-১৯ থেকে ২৭-১০-২০ পর্যন্ত |
১৭ | শফিকুল আলম | ০৫-১১-২০ থেকে – |
প্রতিষ্ঠাতা ও অন্যান্য সহযোগী সদস্যবৃন্দের মহতী উদ্যোগ ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে অত্যন্ত ছোট পরিসরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের প্রাণকেন্দ্রে যে প্রতিষ্ঠানটি একদিন গড়ে উঠেছিল, হাটি হাটি পা পা করে আজ তা আধুনিক সাজে সজ্জিত হয়ে দেশের সেরা একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে দেশের অগণিত ছাত্র-ছাত্রী আলোকিত মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে এবং সগৌরবে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মুসলিম মডার্ন একাডেমিতে বর্তমানে ২ শিফটে প্রায় ২৫০০ ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়ন করছে। বর্তমান প্রধান শিক্ষক খন্দকার মুশতাক আহমদ আলমগীর স্যারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপে ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় এবং ৬৬ জন দক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকমন্ডলী, একজন লাইব্রেরীয়ান, একজন অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক, দুইজন হিসাব করণিক ও ১১ জন সহায়ক কর্মচারীর নিবিড় তত্ত্বাবধানে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।